উত্তম কুমার আচার্য্য
বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম : প্রেক্ষিত পরিবেশ প্রতিবেশ
“চট্টলে দক্ষ বাহুর্যে ভৈরব চন্দ্রশেখরঃ
ব্যক্তরূপা ভগবতী ভনানী তন্ত্র দেবতা।” (চূড়ামনি তন্ত্র)
“নাচিম চ্ সাবা যায়াত রিবায়াল করণ্ফোল।
“...like the coast breeze comes
laden with fragrance of clover.”
পূর্বদেশের (চট্টগ্রামের) লবঙ্গের সুবাসে সুবাসিত সমীরণ
(সাবায়ে মুয়াল্লিকা/ইমরুল কায়েস)।
প্রকৃতির অকৃত্রিম দানে ধন্য চট্টগ্রাম। ভৌগলিক কারণে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই চট্টগ্রাম সমুদ্র বিধৌত, নদীমেখলা, গিরিকন্তলা ও শ্যামলে সুষমায় মন্ডিত।
চৌধুরী পুর্নচন্দ্র দেববর্মা তত্ত্বনিধি ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ এর প্রথম অধ্যায়ে চট্টগ্রামের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন- ‘প্রকৃতির লীলাভূমি “শৈলকিরীটিনী” “সাগরকুন্তলা চট্টলভূমি ভারতের সুদূর পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। ইহার নৈসর্গিক সৌন্দর্য এমন মনোহারী যে, বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ভ্রমণকারী ও ভাবগ্রাহীরা ইহাকে আপনাদের মনঃপুত কত কত নামে অভিহিত করিয়াছেন তাহা নির্ণয় করা সুকঠিন।’ চট্টগ্রামের ৩০টিরও বেশী আদি নাম ও অভিধার মধ্যে বেশকিছু চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রকৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করে যেমন- রম্যভূমি (পালি গ্রন্থ), আদর্শদেশ (পাতঞ্জল সূত্র) পুষ্পপুর, সহরে সবুজ (সহরে সব্জ), পার্ব্বতী প্রভৃতি। প্রাগৈতিহাসিক, বৈদিক যুগ, রামায়ন-মহাভারতীয় যুগ, মৌর্য শাসনামল, সুলতানী, মুঘল, ব্রিটিশ আমলের পর পাকিস্তানী শাসনামলের মধ্য দিয়ে প্রায় চার হাজার বছরের অধিককালের পথপরিক্রমা শেষে আধুনিক চট্টগ্রামের উন্মেষ। বলাবাহুল্য চট্টগ্রামের অপরূপ প্রকৃতিই চট্টগ্রামকে দিয়েছে এই বর্নিল ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের উত্তরাধিকার। একমাত্র মরুভূমি ব্যতীত অন্য প্রায় সকল প্রকার প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ চট্টগ্রামে রয়েছে যেমন : সমুদ্র, নদী, পর্ব্বতশ্রেণি, গিরিপথ (ঢালা), অন্তরীপ, ফাড়ি, উপকূল, উপত্যকা, মালভূমি, জলপ্রপাত, আগ্নেয়গিরি (বর্তমানে মৃত, সেখানে উষ্ণ প্রস্রবন রয়েছে), হ্রদ, চিরহরিৎ পত্রপতনশীল বনভূমি, সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, দ্বীপ, সৈকত, মোহনা, প্রবাল প্রাচীর প্রভৃতি। এসব কারণে চট্টগ্রাম শুধু বাংলাদেশ বা ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, সমগ্র পৃথিবীতে অনন্য।
চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশের রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। প্রাচীন অনেক লেখক, কবি, পরিব্রাজকের লেখায় চট্টগ্রামের সমৃদ্ধ পরিবেশের দিকটি উঠে এসেছে অনন্য ও বহুমাত্রিকতায়। তাঁরা চট্টগ্রামকে বিশাল সাগর-পরিখা-বেষ্টিত, অত্যুচ্চ শৈলপ্রাচীরমন্ডিত, হরিদ্বর্ন বৃক্ষরাজি-সুশোভিত’ বলেছেন। প্রাচীন দেবীপুরান, চূড়ামনি- বাহারীতন্ত্রে, যোগিনীতন্ত্রে, মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যে কবি আলাওল ও দৌলতকাজীর ছয়ফুল মুল্লুক, লোরচদ্রানী, পদ্মাবতী কাব্যে চট্টগ্রামের স্থান ও পরিবেশের উল্লেখ রয়েছে- যেমন : যক্ষশ্চক্রে জনকতনয়া নপূন্যোকেষু/ গ্নিচ্ছায়াতরুষু বসতিং রামগিয্যষুশ্রমো (রামগড়)।” পূবর্ৎমেঘম্ (মেঘদূত, কালিদাস)। দক্ষিণে সাগরসীমা, উত্তরে পর্ব্বত হিমা/ মধ্যে যত পর্বত কানন।’ (ছয়ফল মুল্লুক) ‘মনোহর মনোরম, অমর নগর সম/ শতে শতে অনেক নিবাস/ লবনাম্বু সন্নিকট, কর্ণফুলী নদীতট শুভপুরী অতিদিপ্যমান। (লায়লী মজনু/ কবি দৌলত উজির বাহরাম খাঁ/ ১৬০০ শতক)। শ্যামল শীতল কুঞ্জে গায় সদা পিকদল/ এই যে চট্টভূমি প্রকৃতির লীলাস্থল।’ (তত্ত্বতরঙ্গিনী/ পূর্নচন্দ্র দেববর্ম্মা)।
প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রাম দেশের ও বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এসেছে। কেবল উৎকৃষ্ট পোতাশ্রয় ও অত্যন্ত ব্যস্ত বন্দর হিসাবেই নয়, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্যও চট্টগ্রামের খ্যাতি সুদূর বি¯তৃত হয়ে পড়েছিল। বিদেশী পর্যটকেরা যাঁরাই চট্টগ্রাম ভ্রমন করতে এসেছেন তাঁরাই এ অঞ্চলের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। আফ্রিকান পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, আরবীয় বনিকগণ ও আল ইদ্রিসী, ইবনে খুরদাদবেহ, সুলেমান মাহেরী প্রমুখ ভৌগলিক-ঐতিহাসিকগণ চট্টগ্রামের মনোরম পরিবেশের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। চীনের লেখক পরিব্রাজক ওয়াং তা-ইউয়ান তাঁর তাও-রি-চি-লিয়েহ্তে বর্ণনা করেছেন- ‘এ দেশে পাঁচটি উচ্চ ও শিলাবন্ধুর পর্বতমালা এবং একটি গভীর অরণ্য আছে। ক্ষেত্রগুলো খুবই শস্যসমৃদ্ধ। স্বর্গের বিভিন্ন ঋতু এই রাজ্যের উপরে সম্পদ ছড়িয়ে দিয়েছে।’ খ্যাতনামা পর্তুগীজ ঐতিহাসিক ক্যাম্পোস বলেছেন- সেসময় চট্টগ্রাম ছিল প্রাচ্যের রানী’। পতুর্গীজ কাব্যেও চট্টগ্রামের সৌন্দর্যের প্রশংসা প্রতিফলিত হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিখ্যাত ইংরেজ মনিষী স্যার উইলিয়াম জোনস চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ছিলেন। আলোকজান্ডার হ্যানিস্টেন চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করে এতই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন, যখন কোন ইউরোপীয় বাংলায় বসবাস করতে মনস্থ করেন তখন তাঁরা চট্টগ্রামকে কেন নির্বাচন করেন না তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ইংরেজ সিভিলিয়ান এ. এল. ক্লে’র ‘লিডস্ ফ্রম এ ডায়েরী ইন লোয়ার বেঙ্গল’ নামক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে লিখেছেন- নিুবঙ্গের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা চাটগাঁ। নিচু টিলা, তার চূড়োয় বাড়ি, পাকদন্ডী বেয়ে উঠতে হয়। কোনো কোনো পাহাড়ে বা টিলায় উঠলে চমৎকার সব দৃশ্য চোখে পড়ে। দূরে দিগন্তে কর্ণফুলী গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। পাহাড়ের উপর থেকে নিচে তাকালে চোখে পড়ে সরু রাস্তা উপত্যকা, আর ঝরনা ফাঁক দিয়ে দেখা দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আবার ঝোপের আড়ালে।’ তিনি আরও লিখেছেন, চাঁটগা ছিল তখন জঙ্গলাকীর্ন। দিনে দুপুরেও বাঘের গর্জন শোনা যেত। চাটগাঁর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা ছিল টাইগারপাস। দু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সমুদ্র বরাবর। লেপার্ড (খবড়ঢ়ধৎফ) পাস নামেও একরকম একটা রাস্তা ছিল।
শহরের আশেপাশের জঙ্গলে পাওয়া যেত প্রচুর বনমোরগ-সাইপ। তাঁর বর্ণনা থেকে আরও জানা যায়, হরিনের ডাক ও বাঘের উপদ্রব তখনকার চট্টগ্রাম শহরের সাধারন বিষয় ছিল।
কালক্রমে চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা সরাসরি প্রবর্তিত হয়। ফলে বন্দর শহর চট্টগ্রামকে ঘিরেই গড়ে ওঠে তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রম। বিভিন্ন ইংরেজ রাজ কর্মচারীর চট্টগ্রামে আগমন ও অবস্থান শুরু হয়। পাহাড়ী চড়াই উৎরাইয়ে ঝোপ জঙ্গল দেখে তারা কমিটি ফরদি স্যানিটারী ইমপ্রুভমেন্ট অবদি টাউন চিটাগাং’ গঠন করে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশকে তাদের জন্য বাসযোগ্য করার কাজ শুরু করে। এখানে যতটা না নগরবাসীর পরিবেশের কথা ভাবা হয়েছিল তার চেয়েও বেশী ভাবা হয়েছিল ইংরেজদের সুবিধার কথা। তাঁরা কিছু পরিবেশ সংরক্ষণমূলক কাজ যেমন, রাস্তাঘাট, নালানর্দমা, সেতু নির্মাণ, পুকুর-ডোবা সংস্কার, কুয়া তৈরী, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রভৃতি কার্যক্রম শুরু করেছিল। যথাসম্ভব প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুন্ন রেখে তারা তাদের বাসস্থান ও প্রশাসনিক কার্যালয় স্থাপনের কাজ করে গিয়েছিল। পাহাড়ের উপরে তাদের তৈরী বিভিন্ন বাংলো, প্রশাসনিক ভবনের বেশকিছু এখনও সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তারা পাহাড়কর্তন ও ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধন না করেও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬২ পর্যন্ত সময়ে ইংরেজ শাসকগণ চট্টগ্রামের পরিবেশ উন্নয়নে বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠান করে। ‘উন্নয়ন কাজ বলতে উল্লেখ করা হয়েছে ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করা, নালানর্দমা নির্মাণ ও সংস্কার, পুল নির্মাণ, পানির জন্য কূপ খনন, রাস্তা নির্মাণ, ডোবা থেকে জল নিষ্কাশন, পাহাড়ি পথগুলোকে পরিস্কার ও সংস্কার করে চলাচলের ব্যবস্থা করা, খালগুলোর উন্নয়ন, খানাখন্দকগুলোর তুলনামূলক উচ্চতা নির্ধারন জরিপ, খালপাড়ে পাকা বাঁধ নির্মাণ, রাস্তাঘাটের নকশা ঠিক করা, ভূমির তুলনামূলক উচ্চতা নির্ধারণ জরিপ, পায়খানা স্থাপন, পুকুর পরিষ্কার, পাকা নর্দমা নির্মাণ, মশা নিয়ন্ত্রন’ প্রভৃতি। পরিবেশের উন্নয়নে তারা সচেতন ছিলেন । তখন ধোপারা কাপড় ধুতেন ছড়ার পানিতে। অনেকে ছড়ার পাড়ে নিজেদের পায়খানা নির্মাণ করে। পায়খানার পানিতে ছড়ার পানি দূষিত হচ্ছে এজন্য সভায় প্রস্তাব হয় ম্যাজিষ্ট্রেট যেন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।’ (চট্টগ্রাম পৌরসভার ১৫০ বছর তথ্যে পূর্বাপর)
ব্রিটিশ শাসনামল অতিক্রম করে চট্টগ্রাম প্রবেশ করে পাকিস্তান শাসনামলে। এ আমলে চট্টগ্রামের পরিবেশ উন্নয়নে বড়সর কোন পরিকল্পনা না হলেও উন্নয়ন কার্যক্রমে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণে পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখার বিষয়টি লক্ষ্যনীয়। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামে নগরায়নের হার বাড়তে থাকে এবং গত কয়েক দশকে তা’ প্রবল গতি লাভ করে। দ্রুত খালি জায়গা আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে ও স্থাপনায় পরিনত হতে থাকে। পুকুর-ডোবা-জলাশয় ভরাটের মহোৎসব শুরু হয়। পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ, পাহাড়ের মাটি দিয়ে পুকুর ভরাট, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন প্রভৃতি চট্টগ্রামকে ঠেলে দিয়েছে ব্যাপক পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে। পরিবেশ সংরক্ষণে নেয়া কর্তৃপক্ষের অসংখ্য শুভ উদ্যোগ এর লোলুপ বাসিন্দাদের অপরিনামদর্শীতার ও অসহযোগিতার কারণে বার বার ব্যর্থ হয়ে চলেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কু-প্রভাব। দখলে দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী। ক্রমবর্ধমান স্থাপনা নির্মাণ, পাহাড় কর্তন, নালা-খালে আবর্জনা ফেলার ফলে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বেড়ে গেছে পাহাড় ধ্বস। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও সবুজ বেষ্টনী নষ্ট করার কারণে ঝুঁকির মুখে পড়েছে চট্টগ্রাম।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা খবরে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পরিবেশ বিপর্যয়ের একটা ধারণা আমাদের সামনে উঠে আসে। যদিও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কর্মকান্ডের একটা সামান্য অংশই কেবল গণমাধ্যমে আসে। স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় জুন ২০১৩ ও জুলাই ২০১৩ মাসের দৈবচয়ন পদ্ধতিতে তুলে নেয়া মাত্র কয়েকটি দিনের বিভিন্ন পত্রিকার ছবি ও প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করি। দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ ৪ জুন ২০১৩-এ ছবি ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পাহাড় ধ্বসে মৃত্যু ঠেকাতে ঘরে ঘরে তালা’ শিরোনামে। ১৫ জুন ২০১৩-এ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের পরিবেশ নিয়ে ‘দৃষ্টিনন্দন লেকটি এখন আবর্জনার ভাগাড়’ শীর্ষক ছবিসহ প্রতিবেদন। ১৩ জুন/২০১৩ দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদন রয়েছে কর্ণফুলীকে দখল ও দূষন থেকে বাঁচানোর আহ্বান। দৈনিক সমকালে ছবি ও প্রতিবেদন রয়েছে দখলে দূষনে কর্ণফুলী, বিপন্ন জীববৈচিত্র্য-এ শিরোনামে। ১১/৬/১৩ তারিখের প্রথম আলোতে প্রতিবেদন রয়েছে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ন বসতি নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগ নেই’ শিরোনামে। ১৩/৬/১৩ এ একই পত্রিকায় রয়েছে ছবি ও প্রতিবেদন এবারও মুক্তি নেই জলাবদ্ধতা থেকে’ শিরোনামে। ১২/৬/২০১৩ তারিখে দৈনিক পূর্বকোণ লীড নিউজ করেছে ‘শিক্ষার পরিবেশ নেই শিক্ষাঙ্গনে’ (শিক্ষাঙ্গনের পাশে ময়লা আবর্জনার স্তুপের ও ফুটপাত দখলের ছবিসহ)। একইদিনে রয়েছে পানি নিষ্কাশনে বাধা, বহদ্দারহাটে নালা ও সড়ক দখল করে প্রভাবশালীদের দোকান নির্মান (ছবি ও প্রতিবেদন)। ১৩ জুন ২০১৩-তে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ন ও অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদে বাধা’। ১৪ জুন ২০১৩-এ রয়েছে জিইসি মোড়ের ফুটপাথ বেদখল’ বামনশাহী খালের মাধ্যমে পরিবেশ দূষন’-এর ছবি ও প্রতিবেদন। প্রকাশিত হয়েছে ‘বিপন্ন পরিবেশ’ নামে সিরিজ প্রতিবেদন। দৈনিক আজাদী ২ জুন ২০১৩ তারিখে প্রকাশ করেছে পতেঙ্গার ভাঙ্গন কবলিত বেড়িবাঁধের ছবি ও প্রতিবেদন, হাটহাজারীতে ১৮টি পুকুর অবৈধ দখলে, ১৪ জুন ২০১৩-তে চট্টগ্রামের পানি সংকটের ছবি ও প্রতিবেদন, অবৈধ বিলবোর্ডের ছবি, শাহ আমানত সেতুর নীচে দখল ও সীমানা প্রাচীর নির্মান (ছবি ও প্রতিবেদন)। দৈনিক পূর্বদেশ ১ জুন ২০১৩ ছবি ছাপিয়েছে নদীর দু’ধারে তামাক চাষের ছবি। প্রতিবেদন ছেপেছে পাহাড়ে বসবাসরত ঝুঁকিপূর্ন পরিবারের পুনর্বাসন’ শিরোনামে।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রয়াত নুর আহমদ চেয়ারম্যান থেকে শুরু স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় ৩২ জন প্রশাসক, মেয়র, নগরপিতা চট্টগ্রাম পৌরসভা বা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন কিংবা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব পালন করেছেন সকলেই যাঁর যাঁর সাধ্যমত চট্টগ্রামের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছেন এবং এখনও ক্রমবর্ধমান হারে করে যাচ্ছেন। ১৯০১-২ খ্রিষ্টাব্দ অবধি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিসিটর গড় বাৎসরিক ব্যয় হয় ৫১ হাজার টাকা। ২০১৩-১৪ইং সন ঘোষিত বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে ৩,২৯,০৭,৬০,০০০ টাকা, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৩,৫২,৫৯,৪৩,০০০ টাকা, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৫,৫০,৪১,০০,০০০ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর উন্নয়নে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে ক্রমান্বয়ে বেশী বরাদ্দ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন দিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের পরিবেশ উন্নয়নে বেশকিছু বড় পদক্ষেপ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নিয়েছে এবং বাস্তবায়নও করেছে। কিন্তু এসব চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। বেশকিছু প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলমান ছিল এবং অনেকগুলো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় ছিল। এডিপির অধীনে অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবেশ ও পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ সমাপ্তির পথে ছিল। মেরিনার্স বাইপাস উন্নয়নসহ ডাইভারশন খাল ও সন্নিহিত খালসমূহের পুনর্বাসনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৯৯৫ সালে প্রনীত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে ৩ কি.মি. নতুন খাল খনন ও কর্ণফুলী নদীর সাথে প্রধান খালের সংযোগ স্থলে প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করা গেলে নগরীর জলাবদ্ধতা বহুলাংশে হ্রাস পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল (২০১২-২০১৩ সনের সমীক্ষা)। জলাবদ্ধতাকে কমিয়ে আনার জন্য খাল অবৈধ দখলমুক্ত রাখা ও খাল খরাট না করার ক্ষেত্রে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। বাটালী হিলের বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনে আবসন প্রকল্প নির্মান কাজ শুরু হয়েছিল। নগরীর প্রধান ১৬টি খালের প্রায় ১৪৪ কি.মি. খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের ৪১৮ কি.মি. নালানর্দমা থেকে মাটি উত্তোলন কাজও সম্পন্ন হয়েছিল। (সূত্র : মেয়র মহোদয়ের বাজেট বক্তৃতা, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ও দৈনিক আজাদী ২৮ জুন ২০১৩)।
চট্টগ্রাম মহানগরীকে সবুজ বৃক্ষশোভিত করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রতি বছর মাসব্যাপী বৃক্ষমেলা আয়োজন করত। বনবিভাগের পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। এ প্রক্রিয়া ইতোপূর্বেও চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে চলমান নেই। পরিবেশের সুরক্ষার জন্য সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ব্যবস্থা আছে। এর মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন অবৈধ বিল বোর্ড উচ্ছেদ করেছিল। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় কাজ। এছাড়াও আরও নানা রকম কর্মকা- পরিচালনা করা হয় শুধুমাত্র পরিবেশের উন্নয়নের জন্য। নগরীর গুটি কয়েক ওয়ার্ডে সড়ক বনায়ন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরে নানা রকম স্থাপনা ও সাজসজ্জা ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। জামালখান ওয়ার্ডের এমন দৃষ্টান্ত অন্যান্য ওয়ার্ডগুলোর অনুসরণ করতে পারত। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ হতে প্রতিবছর বৃক্ষমেলা আয়োজন এবং স্কুল শিক্ষার্থীদের মাঝে চারা বিতরণ পুনরায় চালু করা প্রয়োজন।
লোকসংখ্যা বৃদ্ধি, শহরের সম্প্রসারণ, ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি এসব নানা কারণে সাবেকী চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির একার পক্ষে নগরীর উন্নয়ন চাহিদা মিটানো সম্ভব না হওয়ায় ১৯৫৯ সালের অর্ডিন্যান্স বলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ স্থাপিত হয়।’ (চট্টগ্রামের ইতিহাস; ওহীদুল আলম)। এর প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি চট্টগ্রামের পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে এর কাজের পরিধি অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী। বেশ কিছু ফ্লাই ওভার নির্মাণ করেছে চউক। কিন্তু পরিকল্পনায় কেমন যেন একটা অগোছালো ভাব লক্ষ্যনীয়। নতুন ভবন নির্মাণ পরিকল্পনায় ও রাস্তা নির্মাণে বৃক্ষায়নকে বাধ্যতামূলক করা এবং বাস্তবায়ন মনিটর করা একান্ত প্রয়োজন। নগরীর সড়কগুলো প্রশাস্ত করা এবং যতদূর সম্ভব সোজা করে এভিনিউ ও স্ট্রীটের আকার দেয়া দরকার। ফুটপাত দখলমুক্ত করে নাগরিক চলাচলের উপযোগী রাখতে হবে। যত্রতত্র অবৈধ পাকিং ও মালামাল মজুদ নিরসন করে যানজট সমস্যার আশু সমাধান করতে হবে।
চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিষ্ঠার পর পানি সরবরাহের কাজই করে যাচ্ছে কিন্তু পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্ব পালনে প্রশ্নাতীত হতে পারেনি। বর্তমানে তড়িঘড়ি করে সারা শহর খুড়ে খুড়ে ওয়াসার কাজ চলছে। এক রাস্তা বার বার করে কাটা হচ্ছে। এতে নগর বাসীর ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।
সে যাই হোক, প্রকৃতি চট্টগ্রামকে দিয়েছে তার উদার হস্ত প্রসারিত করে। কিন্তু চট্টগ্রামের পরিবেশপুষ্ট এই আমরা কি এতে কিছু যোগ করতে পেরেছি? নাকি ক্রমাগত হরণই করে যাচ্ছি- এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজ অত্যন্ত জরুরী। ঘোষণায় বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হলেও চট্টগ্রামবাসীর জীবনমানে নেই তার ছোঁয়া। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলাবদ্ধতা নিরসন, যোগাযোগ অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে একের পর এক প্রকল্প নেয়া হলেও সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে তা অনেক ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে না। সেবাধর্মী সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকট। বাণিজ্যিক রাজধানীর জন্য যে ধরণের নাগরিক সুবিধা, আর্থিক প্রনোদনা, প্রযুক্তিগত বিশেষায়িত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, বড় পরিসরে ও অধিক সংখ্যায় মুক্ত প্রাঙ্গণ/পার্ক থাকা দরকার তার কিছুই নেই। পাহাড়, বনের অবস্থান ও অস্তিত্ব ঠিক রেখে চট্টগ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁসে জেটির পাশাপাশি রিভারভিউ বিনোদন স্পট নির্মাণ করতে হবে। শিল্পজোনগুলো থেকে বন্দর, বন্দর থেকে রাজধানী ও সারা দেশে স্বল্পতম সময়ে সহজে জ্যামমুক্তভাবে পন্য পরিবহন নিশ্চিত করতে হবে। বাস টার্মিনালগুলো পরিকল্পিতভাবে স্থাপন/বিন্যাস করতে হবে। বিমান বন্দরের আধুনিকায়ন ও বিমানবন্দর থেকে শহরে প্রবেশ সহজতর করতে হবে। বনাঞ্চল ও পাহাড় নিধন করে কোনক্রমেই যাতে অবকাঠামো নির্মাণ করা না হয়, বিদ্যমান পুকুর, দীঘি, জলাশয় লেক যাতে কোনক্রমেই ভরাট করা না হয়, খালগুলোর নাব্যতা যাতে কোনভবেই ব্যাহত না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বিশেষায়িত হাসপাতাল, বিশেষায়িত প্রযুক্তি অঞ্চল, বাণিজ্যিক অঞ্চল ও বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চল স্থাপন/রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন করতে হবে পরিকল্পিতভাবে। চট্টগ্রামের পরিবেশ প্রতিবেশ দেশের অন্য যে কোন অঞ্চলের তুলনায় ভিন্ন। সুতরাং চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য চট্টগ্রামের পরিবেশবিদ, পরিকল্পনাবিদ, প্রযুক্তিবিদদের সমন্বয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। অন্যথায় ‘বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম’এ ধারণাটি হবে ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন।’
লেখক : শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ কর্মী ও সভাপতি, ইকো ফ্রেন্ডস।
আপনার মতামত লিখুন :