বিভক্ত দেশ-বিভক্ত পঞ্জি
মাসুম খান
বাংলাদেশ ছোট্ট একটা ভূখণ্ড হলেও এখানে ৪৪টা জাতিগোষ্ঠী সহাবস্থান করে। ৪৪টা ভাষা যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি তাঁদের সাংস্কৃতিক জীবনযাপনেও রয়েছে নানা বিষয় আঙ্গিকে বিচিত্র ধ্যানধারণাসমৃদ্ধ।
পৃথিবীর সকল উৎসবই লোকজ-উৎসবের পথধরে ধর্মীয় বিশ্বাসে দৃঢ়ভাবে স্থান করে এসেছে। ধীরে ধীরে লৌকিক দেবতা অলৌকিক দেবত্বে লাভ করেছে অমরত্ব। বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী দোদুল্যমান গৃহবাসীর আচরণই সংস্কৃতি।
ধর্ম বিশ্বাসের সেকাল-একাল নয় - মানুষ কোনো কালেই অবিশ্বাসী ছিলেন বলে মনে করি না। সর্বকালের সকল মানুষ কোথাও না কোথাও, কারো না কারোর কাছে মাথা নত করেছেন- শান্তির আশায়, প্রত্যাশায়।
ধর্ম মানুষের পারলৌকিক বিশ্বাসের ভিত্তি, সংস্কৃতি মানুষের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে সামগ্রিক জীবনারচণ। সুতরাং ধর্ম আর সংস্কৃতি মিলানোর কোনো সুযোগ নেই। বাঙালি সরাসরি হাত দিয়ে পান্তা ভাত খেতে পারে, পশ্চিমা বিশ্বের কোনো লোক পান্তা তো দূরের কথা খাবারে হাত লাগানো ভাবতেও পারে না। কোনো সংস্কৃতিতে মাছের প্রাচুর্য, কোথাও মাংসের কোথাও বা ফলমূলের। পারলৌকিক বিশ্বাস এখানে অভ্যাসের পরিবর্তন করতে পারে নাই, চাহিদা যোগানটাই মূখ্য। চৈত্র্যসংক্রান্তি, বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা বর্ষবরণ তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির একটি দিক।
বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রয়োজন হয়েছিল মূলত রাজা-বাদশা আর বণিক শ্রেণির প্রয়োজনে। বাৎসরিক পাওনা আদায়ের উৎসব কেন্দ্র করে, প্রজাশ্রেণিও বাৎসরিক খাজনা/দাদনের টাকা পরিশোধ করে ঘরে বা মহাজনের দেয়া উৎসবে যুক্ত হয়েছে।
রাজা/বাদশা/জমিদার/শাসকদের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকেও সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকার পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ করে, সেই প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছায়ানটের জন্ম।
উইকিপিডিয়াতে লেখা হয়েছে- '১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী উৎযাপনের পর একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন কয়েকজন সংগঠক। তাদের মধ্যে মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই নামে পরিচিত), শামসুন্নাহার রহমান, সুফিয়া কামাল, ওয়াহিদুল হক অন্যতম। সাঈদুল হাসানের প্রস্তাবে সংঠনটির নামকরণ করা হয় ছায়ানট। ১৯৬১ সালে সুফিয়া কামালকে সভাপতি আর ফরিদা হাসানকে সম্পাদক করে প্রথম কমিটি গঠিত হয়। সহ-সভাপতি জহুর হোসেন চৌধুরী, সাঈদুল হাসান। সহ-সম্পাদক সাইফুদ্দীন আহমদ মানিক, মিজানুর রহমান ছানা। কোষাধ্যক্ষ পদে মোখলেসুর রহমান ও সদস্যরা ছিলেন কামাল লোহানী, ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন, আহমেদুর রহমান প্রমুখ। ১৯৬৩ সালে সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে বাংলা একাডেমির বারান্দায় সঙ্গীত শেখার ক্লাস শুরু হয়। এ বছরেই সালেই ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১লা বৈশাখ, ১৩৭০ বঙ্গাব্দে ওস্তাদ আয়েত আলী খান এই বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেন। ইংরেজি ১৯৬৪ সাল, বাংলা ১৩৭১ সালের ১লা বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ পালন শুরু করে। কালক্রমে এই নববর্ষ পালন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়।'
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সমান্তরালে যুক্ত হতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্রেরা। তারা শোভাযাত্রার প্রচলন করে। প্রতি বছর কোনো না কোনো শ্লোগান শোভাপায় তাদের শোভাযাত্রা। পরবর্তীতে গোলাম আযম, সাইদি, কাদের মোল্লা প্রমুখ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি মঙ্গল শোভাযাত্রার থিম হয়ে ওঠে। 'স্বৈরাচার নিপাত যাক' শ্লোগানে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ১৯৮৫-তে শুরু করে। এরশাদ এ সময়ে কোনোভাবেই জনগণকে একত্র হতে দেয়নি, ফলে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কার্যক্রম চলতে থাকে। উৎসবে উৎসবে রাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রধান দুই ধর্মীয় বিশ্বাসী সনাতনী ও ইসলাম অনুসারী সকলের অংশগ্রহণ থামাতে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কার করেন এরশাদ। এতে পহেলা বৈশাখ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়।
প্রগতির রাজনীতিতে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশ সরকার পরিচালনা করছে। ভারত-বাংলাদেশে জ্যোতিষ শাস্ত্রের পন্ডিত এখনো যদি কিছু বেঁচে থাকে, তাহলে বাংলা বর্ষপঞ্জির অভিন্নতা পুনস্থাপন সময়ের সময়ের দাবি মাত্র।
দিল্লি থেকে ঢাকার দ্রাঘিমা ৩০° এগিয়ে। দিল্লিতে সূর্য ভোর ছয়টায় দেখা গেলে ঢাকা দেখা যায় ভোর সাড়ে পাঁচটায়। সুতরাং হিসাব মতে ১ বৈশাখের সূর্য দিল্লির সময়ের ৩০ মিনিট আগে ঢাকায় দেখা যাবার কথা। কিন্তু সাড়ে তেইশ ঘণ্টা আগে কি করে ঢাকায় বৈশাখ আসে ! বাঙালি সত্বার অভিন্নতার স্বার্থে বাংলা বর্ষপঞ্জির অভিন্নতা একান্ত প্রয়োজন। - শুভ বঙ্গাব্দ
লেখক: গবেষক, কবি, গীতিকার
[ছবি : সৌজন্যে : https://rupayon.com/pohela-boishakh-pictures/]
আপনার মতামত লিখুন :